শরীফ আহমদ, দক্ষিণ সুরমা: চলছে ভাষার মাস। অথচ ভাষার মাসেও মহান ভাষা সৈনিকদের প্রতি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উদাসীনতায় বিদগ্ধ মহল ক্ষুব্দ। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা, ব্যক্ত করা হচ্ছে ক্ষোভ আর তীব্র প্রতিক্রিয়া। আলোচ্য বিষয়টি হচ্ছে পীর হবিবুর রহমান সিলেট সিটি পাঠাগার নিয়ে। কিন্তু সিলেট সিটি করপোরেশনের উদাসীনতায় অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে এই পাঠাগার। দীর্ঘদিন থেকে নগর কর্তৃপক্ষ এ পাঠাগারের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনার গল্প শোনালেও বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও লক্ষণীয় হচ্ছে না। যা একজন ভাষাসৈনিকের প্রতি চরম অবহেলা হিসেবেই দেখছেন সিলেটের সচেতন মানুষেরা।
দেশের প্রায় প্রতিটি শহরের ন্যায় সিলেটের সুরমা নদীর পাড়ে, মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সিলেট পৌর পাঠাগার। ২০০৩ সালে সিলেট পৌরসভাকে সিলেট সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করা হলে এর প্রথম মেয়রের দায়িত্ব পান মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক পৌর চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। এরই একপর্যায়ে ২০০৪ সালে সিলেট সিটি পাঠাগারের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের কিংবদন্তী প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আজীবন অসাম্প্রদায়িক, সাবেক সংসদ সদস্য, নির্লোভ ব্যক্তিত্ব, বৃহত্তর সিলেটের দক্ষিণ সুরমার লালাবাজার ইউনিয়নের বাঘরখলা গ্রামের কৃতীসন্তান জননেতা পীর হবিবুর রহমানের নামে ‘জননেতা পীর হবিবুর রহমান সিলেট সিটি পাঠাগার’ নামে নতুন নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে জননেতা আবুল মাল আব্দুল মুহিত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোগী বন্ধুপ্রতীম পীর হবিবুর রহমান পাঠাগারের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বরাদ্দ করেন। ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে গৃহিত প্রকল্পের কাজ ২০০৯ সালে শুরু হয়ে ২০১১ সালে নির্মাণ কাজ শেষে সিটি কর্তৃপক্ষ ভবনটি বুঝে নেয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই নগরির বন্দরবাজারস্থ নগর ভবন পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনে সিটি কর্পোরেশনের সামগ্রিক কার্যক্রমকে সরিয়ে অস্থায়ী নগর ভবন হিসেবে জননেতা পীর হবিবুর রহমান সিলেট সিটি পাঠাগারে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে ১২ তলা নগর ভবনের ৬ তলার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম পূনরায় বন্দরবাজারস্থ প্রধান নগন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ কৌশলে পীর হবিবুর রহমান সিলেট সিটি পাঠাগারকে দখল করে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে নগরির তোপখানা এলাকায় সুরমা নদীরপাড়স্থ ক্বিনব্রিজের পাশে এ পাঠাগার ঘুরে দেখা গেছে পাঠাগারের বিশাল প্রাঙ্গণজুড়ে সিটি করপোরেশনের যানবাহন আর নষ্ট গাড়ীর যন্ত্রাংশে ভরে রাখা হয়েছে। ভবনে ঝুলছে নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের আর মূল ফটকে নগর এক্সপ্রেসের সাইনবোর্ড। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানেই বছরদশেক আগেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল দেশের রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও ভাষা সৈনিকের নামে গড়া পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার। যেখানে এক সময় হতো বই পাঠ, সেখানে এখন গাড়ির যন্ত্রাংশের জঞ্জাল।
অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে দীর্ঘদিন ব্যবহারের পর বছরতিনেক আগে সিসিক নিজস্ব ভবনে ফিরলেও পাঠাগারটি এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। বিষয়টা সিলেটের সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য যেমন ক্ষোভের, তেমনি কষ্টেরও। একসময় পীর হবিবুর রহমান পাঠাগারে ছিল বইয়ের বিপুল সম্ভার। সিলেটের সাহিত্যপ্রেমিরা যেখানে বসে সাহিত্যচর্চার ক্ষুধা মিটিয়েছেন। যে কারণে নগর কর্তৃপক্ষের মূল্যবোধ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
২০০৪ সালে সিলেট পৌর পাঠাগারকে পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার নামকরণের মাধ্যমে এই ভাষা সৈনিককে সম্মানিত করে নগর কর্তৃপক্ষ। এর আগে কয়েকবার নাম পরিবর্তন হলেও মূল বিষয়ের বিচ্যূতি ঘটেনি। কিন্তু বর্তমান নগর কর্তৃপক্ষের হাতে সিলেটের এই প্রাচীন সাহিত্যপাঠের জায়গাটা নিঃশেষ হওয়ার পথে।
২০১১ সালে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই নিজেদের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় সিলেট সিটি করপোরেশন। বন্ধ হয়ে যায় পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার। এ অবস্থায় ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারটি পূর্বের রূপে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি সিলেটবাসীর।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুরমা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, প্রয়াত জননেতা পীর হবিবুর রহমানের অনুসারী চঞ্চল মাহমুদ ফুলর বলেন ‘দীর্ঘদিন থেকে সিটি কর্পোরেশন তাদের কাজে এ ভবনটি ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে নগর ভবন নির্মাণের পর সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব ভবনে ফিরলেও পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার স্বরূপে ফিরেনি। বলতে গেলে এখন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মূলত নগর কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকৃত উদাসীনতাই এ জন্য দায়ী। তাই আমি বলবো নগর কর্তৃপক্ষ যত দ্রæত সম্ভব পাঠাগারটি পুনরায় চালু করে সিলেটের মানুষের সাহিত্য পাঠের আশ্রয়টি উন্মুক্ত করে দেবে। একই সাথে সামনে কোন একটি জায়গায় এই পাঠাগারের সাথে সম্পর্কিত সিলেটের অতীত ইতিহাস শৃংখলার সাথে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখলে বর্তমান প্রজন্ম তা থেকে উপকৃত হতে পারবে।’
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আশা করছি দ্রæততম সময়ের মধ্যে পীর হবিবুর রহমান পাঠাগারটি পুনরায় চালু হবে। ইতোমধ্যে সকল পরিকল্পনাও আমাদের শেষ হয়েছে। তাই সিলেটের সাহিত্যপ্রেমি ও সচেতন জনগণের আর হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই।’
তিন বছর আগেও তো একই কথা বলা হয়েছিলো; এমন প্রশ্নে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আগামী এক বছরের মধ্যে সব কিছু হয়ে যাবে। এক বছর পর এমন প্রশ্ন করার সুযোগ হবে না।’